জীবনানন্দ দাশের কবিতাসমগ্র - Binodon Khabor
শনিবার,২৬শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

জীবনানন্দ দাশের কবিতাসমগ্র

কবি জীবনানন্দ দাশের অন্যতম কবিতাগ্রন্থ মহাপৃথিবী কবিতার কিছু কবিতা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

by admin
গোধূলি সন্ধির নৃত্য- জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দ দাশের কবিতাসমগ্র: কবি জীবনানন্দ দাশের অন্যতম কবিতাগ্রন্থ মহাপৃথিবী কবিতার কিছু কবিতা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। প্রকৃতির কবি, রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ তার সৃষ্টিশীল কর্মের মাধ্যমে আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন।

কবিতার নাম-  

যেখানে রুপালি জ্যোৎস্না ভিজিতেছে শরের ভিতর, যেখানে অনেক মশা বানায়েছে তাহাদের ঘর;

যেখানে সোনালি মাছ খুঁটে-খুঁটে খায়

সেই সব নীল মশা মৌন আকাঙ্ক্ষায়;

নির্জন মাছের রঙে যেইখানে হ’য়ে আছে চুপ

পৃথিবীর একপাশে একাকী নদীর গাঢ় রূপ;

কান্তারের একপাশে যে-নদীর জল

বাবলা হোগলা কাশে শুয়ে-শুয়ে দেখিছে কেবল

বিকেলের লাল মেঘ; নক্ষত্রের রাতের আঁধারে

বিরাট নীলাভ খোঁপা নিয়ে যেন নারী মাথা নাড়ে

পৃথিবীর অন্য নদী; কিন্তু এই নদী

রাঙা মেঘ— হলুদ-হলুদ জ্যোৎস্না; চেয়ে দ্যাখো যদি;

অন্য সব আলো আর অন্ধকার এখানে ফুরালো;

লাল নীল মাছ মেঘ— ম্লান নীল জ্যোৎস্নার আলো

এইখানে; এইখানে মৃণালিনী ঘোষালের শব

ভাসিতেছে চিরদিন: নীল লাল রুপালি নীরব।

জীবনানন্দ দাশের কবিতাসমগ্র

হাজার বছর শুধু খেলা করে অন্ধকারে জোনাকির মতো:

চারিদিকে পিরামিড— কাফনের ঘ্রাণ;

বালির উপরে জ্যোৎস্না— খেজুর-ছায়ারা ইতস্তত

বিচূর্ণ থামের মতো: এশিরিয়— দাঁড়ায়ে রয়েছে মৃত, ম্লান।

শরীরে মমির ঘ্রাণ আমাদের— ঘুচে গেছে জীবনের সব লেনদেন;

‘মনে আছে?’ সুধালো সে— সুধালাম আমি শুধু, ‘বনলতা সেন।’

দু-এক মুহূর্ত শুধু রৌদ্রের সিন্ধুর কোলে তুমি আর আমি

হে সিন্ধুসারস,

মালাবার পাহাড়ের কোল ছেড়ে অতি দূর তরঙ্গের জানালায় নামি

নাচিতেছ টারান্‌টেলা— রহস্যের; আমি এই সমুদ্রের পারে চুপে থামি

চেয়ে দেখি বরফের মতো শাদা ডানা দুটি আকাশের গায়

ধবল ফেনার মতো নেচে উঠে পৃথিবীরে আনন্দ জানায়।

মুছে যায় পাহাড়ের শিঙে-শিঙে গৃধিনীর অন্ধকার গান,

আবার ফুরায় রাত্রি, হতাশ্বাস; আবার তোমার গান করিছে নির্মাণ

নতুন সমুদ্র এক, শাদা রৌদ্র, সবুজ ঘাসের মতো প্রাণ

পৃথিবীর ক্লান্ত বুকে; আবার তোমার গান

শৈলের গহ্বর থেকে অন্ধকার তরঙ্গেরে করিছে আহ্বান।

জানো কি অনেক যুগ চ’লে গেছে? ম’রে গেছে অনেক নৃপতি?

অনেক সোনার ধান ঝ’রে গেছে জানো না কি? অনেক গহন ক্ষতি

আমাদের ক্লান্ত ক’রে দিয়ে গেছে— হারায়েছি আনন্দের গতি;

ইচ্ছা, চিন্তা, স্বপ্ন, ব্যথা, ভবিষ্যৎ, বর্তমান— এই বর্তমান

হৃদয়ে বিরস গান গাহিতেছে আমাদের— বেদনার আমরা সন্তান?

জানি পাখি, শাদা পাখি, মালাবার ফেনার সন্তান,

তুমি পিছে চাহোনাকো, তোমার অতীত নেই, স্মৃতি নেই, বুকে নেই আকীর্ণ ধূসর

পাণ্ডুলিপি; পৃথিবীর পাখিদের মতো নেই শীতরাতে ব্যথা আর কুয়াশার ঘর।

যে-রক্ত ঝরেছে তারে স্বপ্নে বেঁধে কল্পনার নিঃসঙ্গ প্রভাত

নেই তব; নেই নিম্নভূমি—নেই আনন্দের অন্তরালে প্রশ্ন আর চিন্তার আঘাত।

স্বপ্ন তুমি দ্যাখোনি তো— পৃথিবীর সব পথ সব সিন্ধু ছেড়ে দিয়ে একা

বিপরীত দ্বীপে দূরে মায়াবীর আরশিতে হয় শুধু দেখা

রূপসীর সাথে এক; সন্ধ্যার নদীর ঢেউয়ে আসন্ন গল্পের মতে রেখা

প্রাণে তার— ম্লান চুল, চোখ তার হিজল বনের মতো কালো;

একবার স্বপ্নে তারে দেখে ফেলে পৃথিবীর সব স্পষ্ট আলো

নিভে গেছে; যেখানে সোনার মধু ফুরায়েছে, করে না বুনন

মাছি আর; হলুদ পাতার গন্ধে ভ’রে ওঠে অবিচল শালিকের মন,

মেঘের দুপুর ভাসে— সোনালি চিলের বুক হয় উন্মন

মেঘের দুপুরে, আহা, ধানসিড়ি নদীটির পাশে;

সেখানে আকাশে কেউ নেই আর, নেই আর পৃথিবীর ঘাসে;

তুমি সেই নিস্তব্ধতা চেনোনাকো; অথবা রক্তের পথে পৃথিবীর ধূলির ভিতরে

জানোনাকো আজো কাঞ্চী বিদিশার মুখশ্রী মাছির মতো ঝরে;

সৌন্দর্য রাখিছে হাত অন্ধকার ক্ষুধার বিবরে;

গভীর নীলাভতম ইচ্ছা চেষ্টা মানুষের— ইন্দ্রধনু পরিবার ক্লান্ত আয়োজন

হেমন্তের কুয়াশায় ফুরাতেছে অল্পপ্রাণ দিনের মতন।

এই সব জানোনাকো প্রবালপঞ্জর ঘিরে ডানার উল্লাসে;

রৌদ্রে ঝিলমিল করে শাদা ডান শাদা ফেনা-শিশুদের পাশে

হেলিওট্রোপের মতে দুপুরের অসীম আকাশে!

ঝিকমিক করে রৌদ্রে বরফের মতো শাদা ডানা,

যদিও এ পৃথিবীর স্বপ্ন চিন্তা সব তার অচেনা অজানা।

চঞ্চল শরের নীড়ে কবে তুমি— জন্ম তুমি নিয়েছিলে কবে,

বিষণ্ণ পৃথিবী ছেড়ে দলে-দলে নেমেছিলে সবে

আরব সমুদ্রে, আর চীনের সাগরে— দূর ভারতের সিন্ধুর উৎসবে।

শীতার্ত এ-পৃথিবীর আমরণ চেষ্টা ক্লান্তি বিহ্বলতা ছিঁড়ে

নেমেছিলে কবে নীল সমুদ্রের নীড়ে।

ধানের রসের গল্প পৃথিবীর— পৃথিবীর নরম অঘ্রাণ

পৃথিবীর শঙ্খমালা নারী সেই– আর তার প্রেমিকের ম্লান

নিঃসঙ্গ মুখের রূপ, বিশুষ্ক তৃণের মতো প্রাণ,

জানিবে না, কোনোদিন জানিবে না; কলরব ক’রে উড়ে যায়

শত স্নিগ্ধ সূর্য ওরা শাশ্বত সূর্যের তীব্রতায়।

আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি!

আবার বছর কুড়ি পরে—

হয়তো ধানের ছড়ার পাশে

কার্তিকের মাসে—

তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে— তখন হলুদ নদী

নরম-নরম হয় শর কাশ হোগলায়— মাঠের ভিতরে।

অথবা নাইকো ধান খেতে আর;

ব্যস্ততা নাইকো আর,

হাঁসের নীড়ের থেকে খড়

পাখির নীড়ের থেকে খড়

ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের

জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার—

তখন হঠাৎ যদি মেঠে পথে পাই আমি তোমারে আবার!

হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে

সরু-সরু কালো-কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার,

শিরীষের অথবা জামের,

ঝাউয়ের— আমের;

কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে!

জীবন গিয়েছে চ’লে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার—

তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার!

তখন হয়তো মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে পেঁচা নামে—

বাবলার গলির অন্ধকারে

অশথের জানালার ফাঁকে

কোথায় লুকায় আপনাকে!

চোখের পাতার মতো নেমে চুপি কোথায় চিলের ডানা থামে—

সোনালি-সোনালি চিল— শিশির শিকার ক’রে নিয়ে গেছে তারে—

কুড়ি বছরের পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে!

জীবনানন্দ দাশের কবিতাসমগ্র

কচি লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলোয়

পৃথিবী ভ’রে গিয়েছে এই ভোরের বেলা;

কাঁচা বাতাবীর মতো সবুজ ঘাস— তেম্নি সুঘ্রাণ—

হরিণেরা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে।

আমারো ইচ্ছা করে এই ঘাসের ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো

গেলাসে-গেলাসে পান করি,

এই ঘাসের শরীর ছানি– চোখে চোখ ঘষি,

ঘাসের পাখনায় আমার পালক,

ঘাসের ভিতর ঘাস হ’য়ে জন্মাই কোনো এক নিবিড় ঘাস-মাতার

শরীরের সুস্বাদ অন্ধকার থেকে নেমে।

জীবনানন্দ দাশের কবিতাসমগ্র

গভীর হাওয়ার রাত ছিলো কাল— অসংখ্য নক্ষত্রের রাত;

সারা রাত বিস্তীর্ণ হাওয়া আমার মশারিতে খেলেছে;

মশারিটা ফুলে উঠেছে কখনো মৌসুমী সমুদ্রের পেটের মতো,

কখনো বিছানা ছিঁড়ে

নক্ষত্রের দিকে উড়ে যেতে চেয়েছে;

এক-একবার মনে হচ্ছিলো আমার–আধো ঘুমের ভিতর হয়তো—

মাথার উপরে মশারি নেই আমার,

স্বাতী তারার কোল ঘেঁষে নীল হাওয়ার সমুদ্রে শাদা বকের মতো উড়ছে সে!

কাল এমন চমৎকার রাত ছিলো।

সমস্ত মৃত নক্ষত্রেরা কাল জেগে উঠেছিলো— আকাশে এক তিল

ফাঁক ছিলো না;

পৃথিবীর সমস্ত ধূসর প্রিয় মৃতদের মুখও সেই নক্ষত্রের ভিতর দেখেছি আমি;

অন্ধকার রাতে অশ্বত্থের চূড়ায় প্রেমিক চিলপুরুষের শিশির-ভেজা চোখের মতো

ঝলমল করছিলো সমস্ত নক্ষত্রেরা;

জ্যোৎস্নারাতে বেবিলনের রানীর ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্জ্বল চামড়ার

শালের মতো জ্বলজ্বল করছিলো বিশাল আকাশ!

কাল এমন আশ্চর্য রাত ছিলো।

যে-নক্ষত্রেরা আকাশের বুকে হাজার-হাজার বছর আগে ম’রে গিয়েছে

তারাও কাল জানালার ভিতর দিয়ে অসংখ্য মৃত আকাশ সঙ্গে ক’রে এনেছে;

যে-রূপসীদের আমি এশিরিয়ায়, মিশরে, বিদিশায় ম’রে যেতে দেখেছি—

কাল তারা অতিদূর আকাশের সীমানার কুয়াশায়-কুয়াশায দীর্ঘ বর্শা হাতে ক’রে

কাতারে-কাতারে দাঁড়িয়ে গেছে যেন—

মৃত্যুকে দলিত করবার জন্য?

জীবনের গভীর জয় প্রকাশ করবার জন্য?

প্রেমের ভয়াবহ গম্ভীর স্তম্ভ তুলবার জন্য?

আড়ষ্ট—অভিভূত হয়ে গেছি আমি,

কাল রাতের প্রবল নীল অত্যাচার আমাকে ছিঁড়ে ফেলেছে যেন;

আকাশের বিরামহীন বিস্তীর্ণ ডানার ভিতর

পৃথিবী কীটের মতো মুছে গিয়েছে কাল;

আর উত্তুঙ্গ বাতাস এসেছে আকাশের বুক থেকে নেমে

আমার জানালার ভিতর দিয়ে সাঁই সাঁই ক’রে,

সিংহের হুংকারে উৎক্ষিপ্ত হরিৎ প্রান্তরের অজস্র জেব্রার মতো।

হৃদয় ভ’রে গিযেছে আমার বিস্তীর্ণ ফেল্টের সবুজ ঘাসের গন্ধে,

দিগন্ত-প্লাবিত বলীয়ান রৌদ্রের আঘ্রাণে,

মিলনোন্মত্ত বাঘিনীর গর্জনের মতো অন্ধকারের চঞ্চল বিরাট

সজীব রোমশ উচ্ছ্বাসে,

জীবনের দুর্দান্ত নীল মত্ততায়।

আমার হৃদয় পৃথিবী ছিঁড়ে উড়ে গেল,

নীল হাওয়ার সমুদ্রে স্ফীত মাতাল বেলুনের মতো গেল উড়ে,

একটা দূর নক্ষত্রের মাস্তুলকে তারায়-তারায় উড়িয়ে নিযে চললো

একটা দুরন্ত শকুনের মতো।

You may also like

Leave a Comment

সম্পাদক ও প্রকাশকঃ দেলোয়ার হোসেন

যোগাযোগঃ অফিসঃ ৪৩/বি, নবাবগঞ্জ বাজার, লালবাগ, ঢাকা-১২১১

মোবাইলঃ ০১৭১১৬৬৪৬৬৫

Email: info@janaojana.com

2025 All Rights Reserved by Binodonkhabor.com

অনুসরণ করুন