বাংলার ভৌগোলিক পরিচয় ও বাংলা নামের উৎপত্তি - Binodon Khabor
বৃহস্পতিবার,২৪শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বাংলার ভৌগোলিক পরিচয় ও বাংলা নামের উৎপত্তি

by admin
বাংলার ভৌগোলিক পরিচয়

বাংলার ভৌগোলিক পরিচয় ও বাংলা নামের উৎপত্তি: মানুষের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড ও কীর্তিকলাপ এবং তার অবস্থান ও পরিবেশের মধ্যে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক

রয়েছে। তাই ইতিহাস ও ভূগোলের মধ্যে এক নিবিড় যোগসূত্রের কথা সবাই স্বীকার করেন। যেহেতু মানুষের কর্মকাণ্ড এক বিশেষ

ভৌগোলিক পরিবেশে সংঘটিত হয়, তাই ভূগোলই ইতিহাসের ভিত্তি।

‘বাংলা’ বলতে কোন্ ভূখণ্ডকে বোঝাতো তা স্পষ্ট করে নেয়া প্রয়োজন।

 ‘বাংলা’ বলতে বিস্তৃত এক ভূ-খণ্ডকে বোঝাতো। প্রাথমিক পর্যায়ে একই ভূখণ্ডের মধ্যে বিভিন্ন ভৌগোলিক নামের অবস্থিতি ছিল।

মোটামুটিভাবে ১৯৪৭-এর পূর্বে ব্রিটিশ ভারতের ‘বেঙ্গল’ প্রদেশের ভূখণ্ডই আমাদের আলোচনার বিষয়; বর্তমানে যা ‘বাংলাদেশ’ এবং

ভারতের ‘পশ্চিমবঙ্গ’ প্রদেশ। ইতিহাসের দৃষ্টিতে এই ভূখণ্ডের একটি আঞ্চলিক সত্তা ছিল এবং ভৌগোলিকগণও এই উপমহাদেশের মধ্যে

‘বাংলা’-কে একটি ভৌগোলিক অঞ্চল বলে স্বীকার করেন। প্রায় ৮০ হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত নদীবিধৌত পলি দ্বারা গঠিত এক বিশাল

সমভূমি এই বাংলা। এর পূর্বে ত্রিপুরা, গারো ও লুসাই পর্বতমালা; উত্তরে শিলং মালভূমি ও নেপাল তরাই অঞ্চল; পশ্চিমে রাজমহল ও ছোট

নাগপুর পর্বতরাজির উচ্চভূমি এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর।

এই বিস্তৃত সমভূমির দক্ষিণ দিক সাগরাভিমুখে ঢালু এবং গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র- মেঘনার জলরাশি দ্বারা বয়ে আনা বিপুল পরিমাণ পলি সাগরে উৎসারিত হচ্ছে।

সমুদ্রোপকূলবর্তী নিম্নভূমি জঙ্গলাকীর্ণ। এর পেছনেই প্রায় ৫০ হাজার বর্গমাইল সমতলভূমি, যার গঠনে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা প্রবাহের

অবদান রয়েছে। এই বিস্তৃত সমতলভূমির মধ্যে ত্রিপুরা অঞ্চল (৩০০০ বর্গমাইল) নিকটবর্তী প্লাবনভূমির তুলনায় গড়ে ৬ ফুট উঁচু এবং

এর মাঝামাঝিই রয়েছে ময়নামতী পাহাড়। সিলেট অঞ্চলও গড়ে প্রায় ১০ ফুট উঁচু এবং এরই দক্ষিণ সীমায় অবস্থিত প্লাইসটোসিন যুগে

সুগঠিত মধুপুর উচ্চভূমি। এই উচ্চভূমির উত্তর-পশ্চিম বিস্তৃতিই হচ্ছে ‘বরেন্দ্র’ বা ‘বারিন্দ’ এলাকা। ব্রহ্মপুত্র নদ (যমুনা প্রবাহ) বরেন্দ্রের

পূর্ব সীমা এবং প্রবাহই এই উচ্চভূমিকে মধুপুরের উচ্চভূমি থেকে ভাগ করেছে। পশ্চিমে রাজমহল ও ছোটনাগপুর পাহাড় সংলগ্ন উত্তর

থেকে দক্ষিণাভিমুখে বিস্তৃত প্লাইসটোসিন ভূভাগ রয়েছে। নীহাররঞ্জন রায়ের ভাষায়, ‘এই ভূখণ্ডই ঐতিহাসিককালের বাঙালির কর্মকৃতির

উৎস এবং ধর্ম-কর্ম-নর্মভূমি। একদিকে সুউচ্চ পর্বত, দুইদিকে কঠিন শৈলভূমি আর একদিকে বিস্তীর্ণ সমুদ্র; মাঝখানে সমভূমির সাম্য-ইহাই বাঙালির ভৌগোলিক ভাগ্য।’

বাংলা নামের উৎপত্তি: বাংলার ভৌগোলিক পরিচয়

 ইংরেজ শাসনকালের ‘বেঙ্গল’ (Bengal), যা ১৯৪৭ পর্যন্ত প্রযুক্ত ছিল, উপরে আলোচিত ভূখণ্ডকেই বোঝাতো। ইংরেজদের ‘বেঙ্গল’

অন্যান্য ইউরোপীয়দের (বিশেষ করে পর্তুগীজদের) ‘বেঙ্গালা’ থেকেই নেয়া হয়েছে। এই নামটিই তারা আধিপত্য বিস্তারের সময় পেয়েছিল

বা এই ভূভাগ ইউরোপীয়দের কাছে এই নামেই পরিচিত ছিল। ষোল ও সতেরো শতকে ইউরোপীয়দের লেখনীতে ‘বেঙ্গালা’ নামে দেশের

উল্লেখ পাওয়া যায়। সীজার ফ্রেডারিক (১৫৬৩-১৫৮১) ‘বেঙ্গালা’ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত চাটিগানের ১২০ মাইল দূরে অবস্থিত ‘সোন্দিব’ দ্বীপের

উল্লেখ করেছেন। ডুজারিক (১৫৯৯) প্রায় ২০০ লীগ উপকূল বিশিষ্ট ‘বেঙ্গালা’ দেশের উল্লেখ করেছেন। স্যামুয়েল পচার্স (১৬২৬)-এর

বর্ণনায়ও ‘বেঙ্গালা’ রাজ্যের উল্লেখ রয়েছে। র‍্যাল্‌ল্ফ ফিচ্ (১৫৮৬) ‘বেঙ্গালা’ দেশে ‘চাটিগান’, ‘সতগাম’ (সপ্তগ্রাম), ‘হুগেলি’ (হুগলি) এবং

‘তাণ্ডা’ (রাজমহলের নিকটবর্তী) শহরের উল্লেখ করেছেন।

পূর্ববর্তী ইউরোপীয় ভ্রমণকারীরা ‘বেঙ্গালা/বেঙ্গেলা/বাঙ্গালা’ রাজ্য ও ঐ নামের একটি শহরের কথা উল্লেখ করেছেন।

 এছাড়া মার্কোপোলো (১৩ শতক), ওভিংটন, ব্ল্যুভ (১৬৫০) এবং সসেন (১৬৫২) ‘বেঙ্গালা’ শহরের উল্লেখ করেন। রেনেল এই নামের

শহরের উল্লেখ করেছেন কিন্তু এর অবস্থিতি সম্পর্কে নিঃসন্দেহ ছিলেন না। গ্যাস্টলদি (১৫৬১) তাঁর মানচিত্রে চাটিগামের পশ্চিমে

‘বেঙ্গালা’র অবস্থিতি দেখিয়েছেন। পর্তুগীজ ভার্থেমা, বারবোসা (১৫১৪) বা জোয়াও দ্য ব্যারোসের (১৫৫০) বর্ণনায় ‘বেঙ্গালা’ রাজ্য ও

‘বেঙ্গালা’ শহরের উল্লেখ রয়েছে। ‘বেঙ্গালা’ শহরের অবস্থিতি সম্পর্কে পণ্ডিতবর্গের মধ্যে মতবিরোধ থাকলেও ‘বেঙ্গালা’ রাজ্য যে

‘বাংলা’দেশ অঞ্চলকে বোঝাতো সে বিষয়ে তেমন কোন সন্দেহ নেই।

 মোগল আমলে এই ভূ-ভাগই ‘সুবা বাঙ্গালা’ বলে চিহ্নিত হয়েছিল।

আবুল ফজল এই প্রদেশের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন যে, বাঙ্গালা পূর্ব-পশ্চিমে অর্থাৎ চট্টগ্রাম থেকে তেলিয়াগড় পর্যন্ত ৪০০ ক্রোশ এবং

উত্তর-দক্ষিণে, অর্থাৎ উত্তরে পর্বতমালা হতে দক্ষিণে হুগলি জেলার মন্দারণ পর্যন্ত ২০০ ক্রোশ বিস্তৃত ছিল। এই ‘সুবা’ পূর্বে ও উত্তরে

পর্বতবেষ্টিত এবং দক্ষিণে সমুদ্রবেষ্টিত ছিল। এর পশ্চিমে সুবা বিহার। কামরূপ ও আসাম সুবা বাঙ্গালার সীমান্তে অবস্থিত ছিল। আবুল

ফজল ‘বাঙ্গালাহ’ নামের ব্যাখ্যা দিয়েছেন: ‘বাঙ্গালাহ’র আদি নাম ছিল ‘বঙ্গ’। প্রাচীনকালে এখানকার রাজারা ১০ গজ উঁচু ও ২০ গজ

বিস্তৃত প্রকাণ্ড ‘আল্’ নির্মাণ করতেন; এ থেকেই ‘বাঙ্গাল’ বা ‘বঙ্গালাহ’ নামের উৎপত্তি। অবশ্য আবুল ফজলের এই ব্যাখ্যা সবাই স্বীকার

করে নেননি। রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, প্রাচীন কাল হতে ‘বঙ্গ’ এবং ‘বঙ্গাল’ দুটি পৃথক দেশ ছিল। ‘বঙ্গাল’ দেশের নাম হতেই

কালক্রমে সমগ্র দেশের ‘বাংলা’ নামকরণ হয়েছে। বর্তমানকালে বাংলাদেশের অধিবাসীদেরকে যে ‘বাঙ্গাল’ নামে অভিহিত করা হয়, তা সেই প্রাচীন ‘বঙ্গাল’ দেশের স্মৃতিই বহন করছে।

 রমেশচন্দ্র মজুমদারের অনুমানও যে নিঃসন্দেহ নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

বাংলার প্রাচীন জনপদসমূহের মধ্যে ‘বঙ্গাল’-এর তুলনায় ‘বঙ্গ’ অধিক খ্যাতিমান ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই এবং ‘বঙ্গ’ জনপদের মধ্যেই দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার অনেক ভৌগোলিক সত্তাই অন্তর্ভুক্ত ছিল (এর মধ্যে ছিল বঙ্গাল, সমতট, চন্দ্রদ্বীপ *এমনকি সম্ভবত হরিকেল)। তাই ‘বঙ্গ’ থেকে না ‘বঙ্গাল’ থেকে সারা দেশের নাম ‘বাঙ্গালা’ হয়েছে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্ত করা সম্ভব নয়। নীহাররঞ্জন রায় অবশ্য আবুল ফজলের ব্যাখ্যাকে একেবারে অযৌক্তিক মনে করেননি। নদীমাতৃক বারীবহুল দেশে বন্যা ও জোয়ারের স্রোত রোধের জন্য ছোট বড় বাঁধ (আল্) নির্মাণ কৃষি ও বাস্তুভূমির যথার্থ পরিপালনের পক্ষে অনিবার্য। সুতরাং ‘বঙ্গ’-এর সঙ্গে ‘আল্’ যুক্ত হয়ে ‘বঙ্গাল’ বা ‘বাঙ্গাল’ বা ‘বাঙ্গালা’ নামকরণ খানিকটা যুক্তিসঙ্গত।

মোগলপূর্ব যুগে ‘বাঙ্গালা’ সমস্ত ভূখণ্ডের নাম সূচনা করতো কি?

এই প্রশ্নের উত্তরে দেখা যায় যে, বখতিয়ার খলজি কর্তৃক বাংলা বিজয়ের সময় ‘বাঙ্গালা’ নামে একক কোন দেশ ছিল না। ঐতিহাসিক মিনহাজ-ই-সিরাজ মুসলমানদের বাংলা বিজয়ের ইতিহাস রচনার সময় ‘বাঙ্গালা’ নামের উল্লেখ করেন নি; বরং বরেন্দ্র, রাঢ় এবং বঙ্গ নামে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলকে চিহ্নিত করেন। মিনহাজের বর্ণনায় বাংলা সম্বন্ধে তাঁর ভৌগোলিক জ্ঞানের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি লখনৌতি ও বঙ্গকে পৃথক পৃথকভাবে উল্লেখ করেছেন এবং যথাক্রমে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বাংলা এবং পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাকে বুঝিয়েছেন। বঙ্গের সাথে সমতট (সকনত)-এর উল্লেখও তিনি করেছেন।

 মিনহাজের পরবর্তী ঐতিহাসিক জিয়া-উদ-দীন বারণী সর্বপ্রথম ‘বাঙ্গালা’ শব্দ ব্যবহার করেছেন, কিন্তু সমগ্র দেশ নয়, এর অংশ বিশেষের উল্লেখ প্রসঙ্গে। বাংলার ভৌগোলিক পরিচয়

 পরবর্তী ঐতিহাসিক শামস্-ই-সিরাজ আফীফ সুলতান শাম্স-উদ্দ-দীন ইলিয়াস শার্কে ‘শাহ্-ই-বাঙ্গালা’, ‘শাহ্-ই-বাঙ্গালিয়ান’ বা ‘সুলতান-ই-বাঙ্গালা’ রূপে আখ্যা দিয়েছেন। সুলতান ইলিয়াস শাহ সমস্ত বাংলায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন। তাঁর পূর্বে অন্য কোন মুসলমান শাসক দীর্ঘকাল বাংলার সমগ্র ভূখণ্ড শাসন করেছেন একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। ইলিয়াস শাহ বাংলার তিনটি শাসনকেন্দ্রেই (লখনৌতি, সাতগাঁও ও সোনারগাঁও) নিজ আধিপত্য বিস্তার করেন এবং বাংলায় স্বাধীন সুলতানির প্রকৃত ভিত্তি স্থাপন করেন। এই স্বাধীনতা প্রায় দু’শো বছর ধরে অক্ষুণ্ণ ছিল। তাই ইলিয়াস শাহ্ মুসলমান সুলতানদের মধ্যে প্রকৃত অর্থেই প্রথম ‘শাহ্-ই-বাঙ্গালা’ বা ‘সুলতান-ই-বাঙ্গালা’।

সুতরাং একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে যে, আফীফ ‘বাঙ্গালা’ বলতে সারা বাংলাকে অর্থাৎ আবুল ফজলের ‘বাঙ্গালা’ বা ইউরোপীয়দের ‘বেঙ্গালা’, ‘বেঙ্গল’-কে বুঝিয়েছেন। বাংলার ভৌগোলিক পরিচয়

তাই ইলিয়াস শাহের সময় থেকেই প্রথম ‘বাঙ্গালা’ তার ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এর আগে, এমনকি মুসলমান-পূর্ব যুগে, এই ব্যাপক অর্থে ‘বাংলা’ বা ‘বাঙ্গালা’র ব্যবহার পাওয়া যায় না। ঐ সময়ে ‘বঙ্গ’ বা ‘বঙ্গাল’ দ্বারা বাংলার অংশবিশেষকে নির্দেশ করা হতো। তাই ‘বাঙ্গালা’ নামের প্রচলন ইলিয়াস শাহ্-এর সময় থেকেই শুরু হয়েছে একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে। সুকুমার সেন ‘বঙ্গ’ থেকে ‘বাঙ্গালা’ বা ‘বাঙ্গালাহ্’র উৎপত্তি হয়েছে, ‘বাঙ্গালা’ নামটি মুসলমান অধিকারকালে সৃষ্ট এবং ফারসি ‘বাঙ্গালাহ্’ থেকে পর্তুগীজ ‘বেঙ্গালা’ ও ইংরেজি ‘বেঙ্গল’ এসেছে বলে মত প্রকাশ করেন।

You may also like

Leave a Comment

সম্পাদক ও প্রকাশকঃ দেলোয়ার হোসেন

যোগাযোগঃ অফিসঃ ৪৩/বি, নবাবগঞ্জ বাজার, লালবাগ, ঢাকা-১২১১

মোবাইলঃ ০১৭১১৬৬৪৬৬৫

Email: info@janaojana.com

2025 All Rights Reserved by Binodonkhabor.com

অনুসরণ করুন